জাপানের আবহাওয়া ও ভূতত্ত্ব বিষয়ক সংস্থা ‘জাপান মিটিওরোলজিক্যাল এজেন্সি’ (জেএমএ) জানিয়েছে, এই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা প্রায় ৩ মিটার বা ১০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই সতর্কবার্তার পরপরই উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদেরকে দ্রুত উঁচু ও নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ভূমিকম্পের উৎস ও অবস্থান:
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শক্তিশালী এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল জাপানের হোক্কাইদো অঞ্চলে। এটি হাচিনোহে শহর থেকে প্রায় ৮১ কিলোমিটার উত্তর-উত্তরপূর্বে এবং আওমোরি থেকে ১২২ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরপূর্বে অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিক জরিপ বলছে, ভূমিকম্পটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার গভীরে উৎপত্তি হয়েছে। উৎপত্তিস্থল সমুদ্রের তলদেশে হওয়ায় এবং গভীরতা মাঝারি মানের হওয়ায় এর প্রভাবে বড় ধরণের সুনামির আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
কম্পনটি জাপানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি সৃষ্টি করে। হোক্কাইদো এবং তোহোকু অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘরবাড়ি ও স্থাপনাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে দুলতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, কম্পন এতটাই তীব্র ছিল যে ঘরের আসবাবপত্র পড়ে যায় এবং মানুষ আতঙ্কে রাস্তায় নেমে আসে।
সুনামি সতর্কতা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা:
ভূমিকম্পের পরপরই জেএমএ হোক্কাইদো, আওমোরি এবং ইওয়াতে—এই তিনটি প্রধান অঞ্চলের জন্য বিশেষ সুনামির সতর্কতা জারি করেছে। ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় শহরগুলোর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইওয়াতে এবং আওমোরি অঞ্চল অতীতেও সুনামির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাই সেখানকার প্রশাসনের তৎপড়তা চোখে পড়ার মতো।
স্থানীয় গণমাধ্যম এনএইচকে-এর খবরে বলা হয়েছে, উপকূলের দিকে ধেয়ে আসা ঢেউয়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সাইরেন বাজিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সতর্ক করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, “সমুদ্রের দিকে তাকাবেন না, পরিস্থিতি দেখতে যাবেন না, জীবন বাঁচাতে দ্রুত উঁচু স্থানে যান।”
জাপানের ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট ও ঝুঁকি:
জাপান ভৌগোলিকভাবে ‘প্যাসিফিক রিং অফ ফায়ার’ বা আগ্নেয় মেখলার ওপর অবস্থিত। বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত জাপানে প্রতি বছরই ছোট-বড় অনেক ভূমিকম্প হয়। তবে ৭ মাত্রার ওপরের যেকোনো ভূমিকম্পকে ‘মেজর’ বা বড় ধরণের দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করা হয়।
আজকের এই সতর্কতা জাপানিদের মনে ২০১১ সালের ভয়াবহ স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে। সেবার তোহোকু অঞ্চলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ও পরবর্তী সুনামিতে হাজারো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। আজকের ভূমিকম্পের পর ওই অঞ্চলের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে কোনো অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছে কর্তৃপক্ষ।
জরুরি ব্যবস্থা ও ক্ষয়ক্ষতি:
এখন পর্যন্ত বড় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও, রাতের বেলা এমন দুর্যোগ আঘাত হানায় উদ্ধারকাজ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। পূর্ব সতর্কতার অংশ হিসেবে জাপানের রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রভাবিত অঞ্চলে বুলেট ট্রেন (শিনকানসেন) চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। এছাড়া কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবরও পাওয়া গেছে।
জাপান সরকার জরুরি ভিত্তিতে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’ চালু করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী দপ্তর থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল ভূমিকম্পের পর বেশ কয়েকবার ‘আফটারশক’ বা পরবর্তী কম্পন অনুভূত হতে পারে। তাই আগামী ২৪ ঘণ্টা ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সময়। সবাইকে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে।
একনজরে দুর্যোগের তথ্য:
* ভূমিকম্পের মাত্রা: ৭.৬
* সময়: বাংলাদেশ সময় রাত ৮টা ১৫ মিনিট (সোমবার)।
* সুনামির আশঙ্কা: ১০ ফুট (৩ মিটার) উচ্চতার ঢেউ।
* সতর্কতা জারি: হোক্কাইদো, আওমোরি ও ইওয়াতে অঞ্চল।
* উৎপত্তিস্থল: হোক্কাইদো অঞ্চল (সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫০ কি.মি. গভীরে)।
তবে এটি বাংলাদেশের জন্যও একটি সতর্কতা। জাপানে বাংলাদেশি যারা আছেন দূতাবাস থেকে তাদের খোজখবর নেওয়া জরুরী বলে অনেকেই মনে করছেন।

