আজ ৭ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক শেরপুর ও নালিতাবাড়ী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুর জেলা সদর এবং নালিতাবাড়ী উপজেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে এই অঞ্চলে ওড়ে স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ পতাকা।
মুক্তিযুদ্ধের ধাপে ধাপে বিজয়:
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সীমান্তবর্তী এই জেলায় একের পর এক এলাকা শত্রুমুক্ত হতে থাকে। ৪ ডিসেম্বর প্রথমে মুক্ত হয় ঝিনাইগাতী। এরপর ৬ ডিসেম্বর শ্রীবরদী এবং ৭ ডিসেম্বর শেরপুর সদর ও নালিতাবাড়ী অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়। সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর নকলা মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান শেরপুর জেলার পাঁচটি উপজেলা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়।
শেরপুর মুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট:
১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী শেরপুর শহরে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি গাড়ে। তারা শহরের নয়ানী বাজারে টর্চার সেল এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার আহম্মদনগর উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পে অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় কোণঠাসা হতে থাকে শত্রু বাহিনী।

বিশেষ করে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে কামালপুর দুর্গে টানা ১১ দিন অবরোধের পর ৪ ডিসেম্বর সেই ঘাঁটির পতন ঘটে। সেখানে ২২০ জন পাকিস্তানি সেনাসহ বিপুল সংখ্যক রাজাকার ও মিলিশিয়া আত্মসমর্পণ করে। এরপর ৬ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর পিটিআই ক্যাম্পে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকপ্টারযোগে শেরপুর শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে নামেন। সেখানে এক স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে তিনি শেরপুরকে মুক্ত ঘোষণা করেন এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও নালিতাবাড়ী মুক্ত:
নালিতাবাড়ীতে পাকিস্তানি বাহিনী উপজেলা পরিষদ, ফরেস্ট অফিস ও বিডিআর ক্যাম্পে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। ২৫ মে নাকুগাঁও সীমান্তে অতর্কিত হামলায় ৯ জন বিএসএফ সদস্যসহ শত শত বাঙালিকে হত্যা করে ভোগাই নদীতে ভাসিয়ে দেয় তারা। ৩০ জুন তন্তর গ্রামে এবং ২৫ জুলাই সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়, যা ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়।
নালিতাবাড়ী মুক্ত করতে পহেলা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা অভিযান চালালে হাছেন আলী মুন্সি ও আয়াত আলী নামে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর ৪ ডিসেম্বর থেকে পুনরায় তুমুল লড়াই শুরু হয়। টানা দুই দিন দুই রাত গুলি বিনিময়ের পর ৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা পালাতে শুরু করে। অবশেষে ৭ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করেন এবং নালিতাবাড়ী শত্রুমুক্ত হয়।
শহীদের আত্মত্যাগ:
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বর্তমান শেরপুর জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৩০ থেকে ৪০টি খণ্ডযুদ্ধে ৫৯জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামে ১৮৭ জন, শেরপুর সদরের সূর্যদী গ্রামে ৩৯ জন এবং ঝিনাইগাতীর জগৎপুর গ্রামে ৪১ জন সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
আজকের এই দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় সকল শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা।

