ভোর ৪টা। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক মরুভূমির দেশে তখনো সূর্য ভালোভাবে উঁকি দেয়নি। একটি ছোট ঘরে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা আট-দশজন মানুষের মধ্যে সাইফুলের (ছদ্মনাম) ঘুম ভাঙে মোবাইলের অ্যালার্মে। শরীরের ক্লান্তি তখনো কাটেনি, তবুও উঠতে হয়। কারণ, একটু দেরি হলেই দিনের হাজিরা কাটা যাবে। হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশে যখন তার পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন সাইফুলের মতো লাখো প্রবাসী হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জন্য তৈরি হচ্ছেন।
আমরা যাদের ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলে গর্ব করি, তাদের সেই তকমাটির পেছনে লুকিয়ে থাকে এক বুক দীর্ঘশ্বাস, একাকিত্ব আর ত্যাগের এক বিশাল মহাকাব্য।
রঙিন স্বপ্ন বনাম ধূসর বাস্তব বেশিরভাগ বাংলাদেশি তরুণ প্রবাসে পাড়ি জমান রঙিন স্বপ্ন চোখে নিয়ে। কেউ চান পরিবারের অভাব ঘোচাতে, কেউবা ছোট বোনের বিয়ে বা বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাতে। জমি বিক্রি করে বা চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তারা যখন বিমানে ওঠেন, তখন তাদের চোখে থাকে ইউরোপ-আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের জৌলুসপূর্ণ জীবনের ছবি।
কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পর অনেকের ক্ষেত্রেই সেই রঙিন চশমা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের বাস্তবতা অত্যন্ত কঠিন। প্রচণ্ড দাবদাহ, হাড়ভাঙা খাটুনি, অমানবিক কর্মঘণ্টা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস—এটাই হয়ে ওঠে তাদের নিত্যসঙ্গী। অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে কাজ পান না, কেউবা মাসের পর মাস বেতন পান না। তবুও তারা দাঁতে দাঁত চেপে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। কারণ, শূন্য হাতে দেশে ফেরার লজ্জা আর ঋণের বোঝা তাদের তাড়া করে।

“ভালো আছি”—সবচেয়ে বড় মিথ্যা প্রবাসীদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো তাদের বলা “আমি ভালো আছি” বাক্যটি। প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠানোর সময় বা ভিডিও কলে কথা বলার সময় তারা হাসিমুখেই কথা বলেন। ওপ্রান্তে থাকা মা, স্ত্রী বা সন্তান হয়তো আবদার করে নতুন জামা বা ভালো খাবারের। প্রবাসী সেই আবদার মেটান নিজের পেটের ক্ষুধা চেপে রেখে।
৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করে শরীর যখন পুড়ে যায়, কিংবা হাড়কাঁপানো শীতে যখন হাত অবশ হয়ে আসে, তখনো তারা বাড়িতে ফোন করে বলেন, “আমার কাজ খুব আরামের, তোমরা চিন্তা করো না।” এই মিথ্যাটুকু তারা বলেন কেবল পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তাদের এই ত্যাগের খবর হয়তো পত্রিকার পাতায় আসে না, কিন্তু প্রতিটি রেমিট্যান্সের টাকার নোটে মিশে থাকে তাদের ঘাম আর চোখের জল।
একাকিত্বের নোনা জল ও উৎসবহীন জীবন
প্রবাস জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিক হলো একাকিত্ব। ঈদের দিন বা কোনো উৎসবে যখন দেশে খুশির বন্যা বয়ে যায়, তখন প্রবাসীর কপালে হয়তো জোটে না ছুটি। ঈদের নামাজ পড়েই আবার ছুটতে হয় কর্মস্থলে। সেমাই বা পোলাওয়ের স্বাদ তাদের কাছে বিলাসিতা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের নতুন জামা পরা ছবি দেখে তারা চোখের পানি মোছেন। বাবার মৃত্যুতে শেষ দেখা দেখতে না পারা কিংবা সন্তানের বেড়ে ওঠা স্বচক্ষে না দেখার আক্ষেপ বুকে পাথর হয়ে জমে থাকে। প্রবাসীরা বছরের পর বছর ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে দিন গুনতে থাকেন—কবে ফিরবেন প্রিয় জন্মভূমিতে।
দেশের অর্থনীতির ফুসফুস
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার মূল কারিগর এই প্রবাসীরাই। পোশাকশিল্পের পাশাপাশি রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাদের পাঠানো টাকায় দেশে দালানকোঠা ওঠে, ভাই-বোনেরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে।
অথচ, এই বীররা কি তাদের প্রাপ্য সম্মান পান? বিমানবন্দরে হয়রানি, পাসপোর্টের জন্য ভোগান্তি কিংবা লাশ হয়ে দেশে ফিরলে কফিনের অবহেলা—এসব চিত্র আমাদের বিবেকের দিকে আঙুল তোলে। যারা দেশের জন্য এত কিছু করছেন, রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে তাদের প্রত্যাশা খুব সামান্য—একটু সম্মান আর নিরাপত্তা।
শেষ কথা
প্রবাস জীবন মানেই টাকার গাছ নয়; এটি এক কঠোর সাধনা। যারা জীবনের সোনালি সময়গুলো বিদেশের মাটিতে ক্ষয় করে দিচ্ছেন, তারা কেবল তাদের পরিবারের জন্যই নয়, বরং দেশের জন্যই লড়ছেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সংখ্যার চেয়ে তাদের ত্যাগের ওজন অনেক বেশি।
আমাদের উচিত প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। তারা করুণার পাত্র নন, তারা আমাদের গর্ব। তাদের শ্রমে-ঘামে ভেজা প্রতিটি পয়সার সঠিক মূল্যায়ন এবং তাদের প্রতি মানবিক আচরণই হতে পারে তাদের ত্যাগের প্রতি আমাদের সামান্য কৃতজ্ঞতা। দিনশেষে, প্রতিটি প্রবাসীর ঘরে ফেরার স্বপ্ন যেন সত্যি হয়, তাদের দীর্ঘশ্বাস যেন স্বস্তির নিঃশ্বাসে পরিণত হয়—এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
